মাদকের নেশা - কি খায়, কেন খায়?

আলোচ্য বিষয়টি পাঠ করার পর জানতে পারবেন
২। কেন মানুষ নেশা দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়
৩। নেশা দ্রব্যের সাথে প্রেমভালবাসার সম্পর্ক

মানুষের শরীর যেমন শত শত মৌলিক এবং যৌগিক  রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয়ে  গঠিত। তেমনি সিগারেট , মদ , ফেন্সিডিল, হেরোইন , ইয়াবা ইত্যাদি সব মাদকদ্রব্যগুলোও রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। দেহের রাসায়নিক পদার্থের সাথে যখন মাদকের রাসায়নিক দ্রব্যের  বিক্রিয়া হয় তখন দেহের নাজুক কোষগুলো মরে যায়, কিছু আধামরা হয়ে যায় । কোষের ভেতরে এই ধ্বংস যজ্ঞ হয়  তখন আমাদের ব্রেনের ভেতর সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায় , বাড়ী ধ্বসে পড়লে যেমন চারপাশ  ধুলোর ঢেকে যায় তেমনি মাথার মধ্যেও এইরকম ধোঁয়াশা তৈরি হয়, চিন্তা এবং চেতনা আবছা হয়ে যায়, এই অবস্থাকেই মাতাল অবস্থা বলে । মানুষ এই অবস্থাকে নাম দেয় ফিলিংস। মাতলামো বা ফিলিংস করার বিষয়টা অনেকটা এইরকম- আপনার ঘরে আগুন লেগেছে সবকিছু পুড়ে ছায় হয়ে যাচ্ছে , ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আর আপনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না বলে মজা পাচ্ছেন , পোড়া গন্ধ নাকে আসছে বলে আপনার খুব হাঁসি পাচ্ছে! মাদক শুধু আপনার ঘরেই আগুন দেয় না ,   এই উচ্চ ক্ষমতা সম্পূর্ণ পদার্থগুলো শরীরের সুস্থ কোষ এবং অণুগুলোর বন্ধন ভেঙ্গে দেয়,  শরীরের বয়স দ্রুত বাড়িয়ে দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়,  কাজে মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় , পারিবারিক সামাজিক সম্পর্ক বন্ধনগুলোকে শিথিল করে দেয়, মানুষের বেঁচে থাকার আশা, প্রতিটি রাস্তা ধিরে ধিরে বন্ধ করে দেয়ক্রমান্বয়ে মানুষ করুণা , ঘৃণার  পাত্রে পরিনত হয় । মাদকের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কমবেশি জানার পরও আমরা কেন মাধক দ্রব্য গ্রহন করি? আসুন তাহলে খতিয়ে দেখি মাদক দ্রব্য গ্রহন করার সম্ভাব্য কারনগুলোকে---
আসুন জেনে নেই মাদক গ্রহনের  বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ মেকানিজম



শারীরিক ব্যাখ্যাঃ

আমরা যে খাবার খাই তা হজম প্রক্রিয়ার সর্বশেষ পর্যায়ে যেয়ে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন করে ।
এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা পারিবারিক, সামাজিক , পেশাগত ইত্যাদি সব দায় দায়িত্ব পালন করি।
বয়স্ক মানুষের তুলনায় কিশোর এবং যুবকের  শরীরে  অধিক তাপ এবং শক্তি উৎপন্ন হয়।  উৎপাদিত এই অতিরিক্ত শক্তি তাদের অস্থির করে রাখে। যেহেতু শক্তি সংরক্ষণ করে রাখা যায় না সেহেতু এই অতিরিক্ত শক্তি তাদের সবসময় পিড়া দেয়।  কিছু একটা করতে হবে, গড়তে হবে অথবা  ভেঙ্গে  চুরে সব সমান করতে হবে এই কথাগুলো সবসময় তাদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।  যারা সঠিক ভাবে এই অতিরিক্ত এনার্জিটুকু ব্যবহার করতে পারে তারা সফল কাম হয়, আর যারা পারে না তারা  নেশাগ্রস্থ হয়।
শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই । শক্তি কেবল এক রুপ থেকে অন্য রুপে রুপান্তর হতে পারে মাত্র। আর মানুষের দেহে শক্তি জমা করে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। আপনাকে শক্তি খরচ করাই লাগবে। Use it or loose it. হয় আপনি তা ব্যবহার করবেন নয়তো হারাবেন এর বিকল্প কিছু নাই।
যে নিজের ভেতর নেশা দ্রব্যের প্রতি টান অনুভব করে , তাকে বুঝতে হবে তার শরীর  অনেকবেশি এনার্জি তৈরি করছে । সে অনেক বেশি সৃজনশীল ।আর দশটা সাধারন মানুষের চেয়ে অনেকবেশি সম্ভাবনাময়তাই নিজের যত্ন আরও বেশি বেশি নিতে হবে। নিজের শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।


মানসিক ব্যাখ্যাঃ

আমরা জন্মগতভাবে কৌতূহলী। জীবনের জন্য হুমকি হলেও এই কৌতূহল আমাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে না।
বাইরে বাইরে আমরা নেশা দ্রব্যের এবং নেশা গ্রস্থ মানুষের প্রতি তিব্র ঘৃণা অনুভব করি। সেই সাথে প্রতিটি মানুষ একটু হলেও কৌতূহল অনুভব করি নেশা জগতের প্রতি। তবে কোন একজন মানুষও পাওয়া যাবে না , যার স্বপ্ন বড় হয়ে মাতাল বলে পরিচিত  হওয়া। তাহলে কেন কিছু মানুষ নেশাগ্রস্থ হয় এবং অন্য সব মানুষ নেশা দ্রব্যের প্রতি তীব্র টান অনুভব করে?

নেশা শুরু করার আগে এর প্রতি ঘৃণা কিংবা কৌতূহল থাকলেও;  একবার নেশার জগতে ঢুঁকে পড়লে , তখন ঘৃণা , কৌতূহল বদলে যায় ভালবাসায়যদিও এই ভালবাসাটুকু বেশিদিন স্থায়ী হয় না
 তবুও এই ভালবাসাটুকু সর্বাঙ্গে মিথ্যা নাপ্রেমের ছ্যাকা , যে কোন অপ্রাপ্তি, বিষণ্ণতা, পরশ্রীকাতরতা এমনকি শারীরিক রোগের কষ্ট পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এই নেশাদ্রব্য।  নেশাগ্রস্থ ব্যাক্তিরা এই সুখ সময়টুকু বার বার  ফিরে পেতে চায়। অধিক সুখের আশায় নেশার ডোজ বাড়াতে থাকে কিন্তু সেই কাঙ্খিত সুখটুকু আর ধরা দেয় না। তখন নেশাগ্রস্থরা  দ্রব্য পরিবর্তন করে , আরও কিছুদিন সুখের ভেতর কাটে । কিন্তু এই স্বপ্নের স্থায়িত্ব আগেকার মত লম্বা হয় না। এবার শরীর নতুন অভ্যস্ত হয়ে যায়।  খাপছাড়া খাপছাড়া সুখস্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের  মাঝে একপ্রকার ঘোরে মধ্যে সময় কাটতে থাকে
আমরা এতক্ষণে বুঝে গেছি নেশার প্রতি শরীরের চাওয়া আর মনের চাওয়া এক নয়। নেশা শুরুর আগের কাহিনী আর পরের কাহিনী কিন্তু এক নয় বরং  বিপরীত। নেশার মজা নেয়ার জন্য  মাঝখানে   কিছু সময় শরীর মন দুজনে দুজনার হলেও , বেশিদিন তাদের এই প্রেমভাব স্থায়ী হয় না। পুরোপুরি নেশাগ্রস্থ হয়ে যাওয়ার পর শরীর এবং মন দুই বিপরীত প্রান্তে অবস্থান নেয়, পৃথিবীর অন্য কোন মানুষের আর দরকার হয়না একে শাস্তি দেয়ার জন্য মন এবং শরীর নিজেরা নিজেরা ঝগড়াঝাঁটি করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।
শরীর নেশা দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে , সে যে কোন মূল্যে নেশাদ্রব্য পেতে চায়। অন্যদিকে মন তখন বেঁচে থাকার তাগিদে নেশার বেড়াজাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু ততদিনে যেহেতু নেশাদ্রব্যের বিক্রিয়া শরীরের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করেছে সেহেতু এগুলো বাদ দিলেই শরীরে নানারকম অস্বস্তি ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে শরীর তখন নেশাদ্রব্য গ্রহন করার যুক্তি তৈরি করতে থাকে। শরীর মনকে বোঝায় কেন তার নেশাদ্রব্য গ্রহন করা লাগবে। কিভাবে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়া  যাবে।
মন বুঝতে না চাইলে, মনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। শরীরের প্রয়জন প্রাধান্য পায়। মনের যুক্তি ধিরে ধিরে ক্ষীণ হয়ে আসে। মন শরীরের চাহিদার কাছে আসহায়ের মত আত্মসমর্পণ করে। তখন শরীর  ছিনতাই,  চুরি, হত্যাকাণ্ডের মত অপরাধ অনায়াসে করে ফেলে। এমনকি নিজের জন্মদানকারী মা কেউ খুন করতে দ্বিধা করে না নেশাগ্রস্থ দেহ।
এই পর্যায়ে নেশার জাল চারপাশ থেকে মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে তার পৃথিবী আস্তে আস্তে ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যায় । ছোট হতে হতে একেবারে মাটির সাথে মিশে যায়।



এছাড়াও আরও যে সব কারনে মানুষ নেশায় আক্রান্ত হয়
·          বন্ধুদের নেশার ফিলিংসের অতিরঞ্জিত  বিজ্ঞাপন
·         পারিবারিক অস্থিরতা
·         অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা 
·         যৌন উন্মাদনা
·         তথাকথিত সফল নেশাগ্রস্থ বড় ভাইদের অন্ধ অনুকরন
·         নিজেকে ব্যাতিক্রম ভাবা। নেশা অন্যের ক্ষতি করলেও আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না বলে মনে করা।
যে বিশ্বাসটা ইতিমধ্যে আধা বিশ্বাস এবং আধা অবিশ্বাস করে আছে সেই বিষয়ে , সেই সময়ে আরও কিছু বলা যায় তাহলে প্রোপাগান্ডা হয়  অব্যারথ  পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রেম এবং যুদ্ধের সময় প্রোপাগান্ডা ভাল কাজ করে , অর্থাৎ হতবম্ব , বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে প্রোপাগান্ডা সবচেয়ে ভাল কাজ করে, প্রেম এবং যুদ্ধের সময় মানুষের সবকিছু অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক পরিবেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এই সময়ে  মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে , এই সংবেদনশীল মুহূর্তে  মানুষকে যে বার্তাই দেয়া হোক না কেন মানুষ তা দ্রুত বিশ্বাস করে এবং সেই বার্তা অনুযায়ী আচরন করে , প্রোপাগান্ডিষ্টদের  উদ্দেশ্য থাকে ভিন্নমত সবকিছুকে নির্মূল করা,

আধ্যাত্মিক কারন ঃ


 পৃথিবী আমাদের আসল ঠিকানা নয়, আমরা  আসলে কসমিক ট্রাভেলার। আমরা এসেছি বেহেস্ত থেকে। তাই আমারা স্বভাবগতভাবে বেহেশতের কিছু অভ্যাস থেকে গেছে।  সেখানে কোন বাস্তবতার মুখমুখি হতে হয় না, কোন কিছুর অভাব হয় না। কল্পনার সব কিছু সেখানে মেলে। উপভোগের কোন কমতি নেই সেখানে। পৃথিবীতে আমরা তো চলে এসেছি কিন্তু সেই স্মৃতি আমাদের জিনে রয়ে গেছে । বারবার সেই সুখগুলো কল্পনা এবং স্বপ্নের মাঝে আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসে। আমরা নেশাগ্রস্থ হই । কিন্তু আমরা ভুলে যায় আমরা দুনিয়াতে বসবাস করছি এবং সব নেশাদ্রব্যের সাথে  পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও  আছে । এই ভুলে যাওয়ার কারনেই আমরা নেশার ফাঁদে আটকে পরি এবং মরে যায়। অর্থাৎ নেশা গ্রস্থ হওয়ার অন্যতম কারন হয় বাস্তবতা থেকে পলায়ন করতে চাওয়া বিবর্তনবাদের সাহাযে যেমন যে কোন স্বভাবের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বিবর্তন বাদের আরও পেছনে গেলে আমরা আমাদের এই স্বভাবের ব্যাখ্যা খুঁজে পায়।



Comments

Popular Post

নেশার ফাঁদ থেকে মুক্তির আধ্যাত্মিক চিকিৎসা

আত্মার ভেতর এবং বাইরের রহস্য

মাদক, ড্রাগ, নেশা- সর্বনাশা