ডায়াবেটিকস, একটি আধ্যাত্মিক পর্যালোচনা


ডায়াবেটিকস, একটি আধ্যাত্মিক পর্যালোচনা


'আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া'
--------------- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ডায়াবেটিক এর সাথে বসবাস করা কঠিন কাজ। প্রথম যখন আপনার ডায়াবেটিকস ধরা পড়ে, তখনকার কথা মনে আছে। নিয়ম করে  ঔষধ খাওয়া, মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়ে ফেলা, হাঁটাতে আলসেমি করা ইত্যাদি সবকিছু অনেক কঠিন বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু একটা সময় পর এইসব কঠিন কাজগুলোই জীবনের অংশ হয়ে গেছে । এখন আর ডাক্তারকে বলা লাগে না,  কি করতে হবে;  আর কি করা যাবে  না।  নিজের শরীরটাই বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে দেয় নিয়ম মেনে চলবা তো ভাল থাকবা, পরিশ্রম করবা তো সুস্থ থাকবা। নিয়ম মেনে ভাল থাকো  নইলে দরজার কাছে কঠিন কঠিন সব রোগগুলো তোমার শরীরে বাসা বাধার জন্য অপেক্ষা করছে।  এখন তুমিই বেছে নাও , শৃঙ্খলা মেনে সুস্থ সবল ভাবে বেঁচে থাকবা, নাকি আলসেমিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবা। সচেতন মানুষ কঠিন শৃঙ্খলার পথটাই বেছে নেয় , বেঁচে থাকার জন্য, শান্তিতে থাকার জন্য। বেঁচে থাকার মত সুখ তো আর কোন কিছুতে নাই। মরে গেলেই তো সব শেষ । মরার চেয়ে আরও বেশি ভারি, অন্ধ – অক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা । আর সব ডায়াবেটিকস রোগীরাই জানে একটু অনিয়ম করলে এসব রোগের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কত বেড়ে যায়। এতো গেল ডায়াবেটিকস হওয়ার অন্ধকার দিক , এর আলোকিত  দিকও আছে। পৃথিবীর কোন কিছুই যেমন সার্বিক ভাবে খারাপ নয়,  তেমনি ডায়াবেটিক রোগে  আক্রান্ত হওয়াও সব দিক  থেকে মন্দ নয়!


 ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত হলে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোন থেকে  শরীর , মন , আত্মার  পরিবর্তন গুলো পর্যবেক্ষণ করবো।  

শরীর ঃ
একবার ডায়াবেটিক হলে শরীরের সাথে আরও বেশি ঘনিষ্টতা অনুভব করবেন। শরীরের অনুভূতিগুলোকে পরিমাপ করতে শিখবেন। ডায়াবেটিকস হলে শুধু আপনি রক্তের গ্লুকোজ মাপাই শিখবেন না , চোখের ঝাপসা দৃষ্টি , আঙ্গুলের মাথায় কিংবা  পায়ের তালুর শিরশিরানি, অবস শরীরের নিঃশেষ হওয়া শক্তি,ওজন, এছাড়াও আরও অনেক কিছুই  মাপতে শিখবেন। শরীর নানান সংকেত সম্পর্কে এই গভীর সচেতনতা । ক্ষণে ক্ষণে শরীরের ভেতরের পরিবর্তন আপনাকে জানান দেবে কখন আপনি যত্ন নিতে ভুল করেছেন , কি ভুল করেছেন , কেন করেছেন?   পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে কখন  আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ শরীরের প্রতিটি অনুভূতির ব্যাপারে আপনি আরও বেশি শিক্ষিত আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠবেন।  
মন ঃ
ডায়াবেটিকস হলে অকারনে মেজাজ খিটখিটে  হয়ে যাবে। একটু সচেতন হলে নিজের  আবেগের ওঠানামা দেখতে পাবেন  । বিষণ্ণতা ভর করবে  । আলসেমি সারা শরীরে যেকে বসবে । মন অসাড়  আর অবসন্ন হয়ে আসবে। বোঝার কোন উপায় থাকবে, এই উটকো অসুস্থতা গুলো কি শারীরিক নাকি মানসিক? হরমোনের পরিবর্তনের জন্যই এসব নেতিবাচক চিন্তা এবং অনুভূতি মনের মধ্যে তৈরি হয় ।
ডায়াবেটিকস এ আক্রান্ত হবার পর প্রথম উপলব্ধি করবেন জীবন কত ঠুনকোআরও বুঝতে পারবেন অসুস্থতার কষ্ট । একেবারে  অসুস্থ হওয়া না পর্যন্ত,  সুস্বাস্থ্যকে জীবনভর  আমরা কত অবজ্ঞা করেছি সেটাও বুঝবেন।  ডায়াবেটিকস জীবনকে নতুন দৃষ্টিকোন থেকে দেখার সুযোগ করে দেবে; যা আপনি ডায়াবেটিকস এ আক্রান্ত না হলে কখনই উপলব্ধি করতে পারতেন না। আপনি যখন ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হবেন তখন  নিজেকে ভালবাসতে শিখবেন, নিজের সব দুর্বলতাগুলোকেউ ভালবাসতে এবং ব্যাবহার করতে শিখবেন। ডায়াবেটিকস আপনাকে আরামের জাইগা থেকে টেনে বের করে সংগ্রাম মধ্যে নিয়ে যাবে। আপনি বুঝবেন সংগ্রাম যত কঠিন হবে , অর্জন গুলো হবে তত আনন্দের।

আত্মা ঃ 
প্রথম যখন ডায়াবেটিকস ধরা পড়লো তখন ভাবতাম আমি কি এমন করেছি যে এই রোগ আমাকে ধরলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে যখন ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম তখন একটা বিষয় তীব্রভাবে অনুভব করলাম,  ডায়াবেটিকস আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে এই কারনে যে, আমি যেন জীবিত অবস্থায়  নিয়ম-শৃঙ্খলার মর্ম বুঝতে পারি, জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলোকে খুঁজে বের করতে পারি।  
ডায়াবেটিকস হওয়া মানে হল বুড়ো হওয়ার আগেই মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া,বেঁচে থাকতে থাকতেই নিজের আমলনামার হিসেব নিকেশ কষে ফেলাযেসব মানুষের ডায়াবেটিকস আছে নিশ্চিত ভাবেই তারা আত্মো অনুসন্ধান করতে করতে নিজের জীবনের  লক্ষ্য উদ্দেশ্য খুঁজে পায় ডায়াবেটিকস আত্মো অনুসন্ধান এবং আত্মো আবিস্কারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে।  জানুন বুঝুন নিজের ভেতরের গোপন সব সংকেতের পাঠোদ্ধার করুন ।

 আমরা বর্তমানে যে যুগে বসবাস করছি যার বাইরের আবরণ বাইরের  সুদৃশ্য এবং মনোরম । কিন্তু ভেতরে শুধু ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে ভরা । উদাহরন দিলে বিষয়টা অনেকটা পরিস্কার হবে। সুন্দর ভাবে উপাস্থপান করা ফাস্টফুড, বাইরে থেকে দেখতে চমৎকার , ঘ্রান , স্বাদ অনন্য  কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রচুর। আরও আছে  টেলিভিশন , মোবাইল , ইন্টারনেটের মত আপাত নিরিহ জিনিষ গুলোও  ক্ষতিকর হয়ে পড়ছে আমাদের জন্য। লাগামহীন ভাবে  মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারনে।  
 এমনিভাবে ক্ষতিকর জেনেও আমরা  কোমল পানীয় , সিগারেট,  ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া এবং  নানান মাদকের নেশায় বুদ হয়ে থাকছি

আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না  আমাদের চিন্তা,  অনুভূতি এবং ইচ্ছাগুলোর  কোনটা কতটুকু প্রাধান্য পাবার যোগ্য। মনের মধ্যে যে ইচ্ছা তৈরি হচ্ছে সেই ইচ্ছা কতটুকু আমাদের জন্য কল্যাণকর সেটাও বুঝে উঠতে পারি না। যেমনঃ ডায়াবেটিকস এ আক্রান্ত হলে মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে বেশি মন চায়, আমরা যদি মনের এই চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে বেশি বেশি মিষ্টি খাবার খায় তবে নিশ্চিত ভাবে আমরা নিজের ক্ষতি করি এবং  নিজেই নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। প্রতিটা ডায়াবেটিকস রোগী জানে কি খাবার তার খাওয়া উচিৎ আর কি খাওয়া উচিৎ নয়।  ডাক্তার যে সব খাবার খেতে নিষেধ করে , সেই সব খাবারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে এবং হাজারো বাঁধা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিকর খাবার খেয়ে ফেলে । মানুষের অনেক তীব্র ইচ্ছা এবং আকাঙ্খা গুলোই যে ক্ষতির আসল কারন , ডায়াবেটিকস রোগীদের কার্যকলাপ থেকেই বোঝা যায়। এটা যেমন ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য সতর্কবার্তা তেমনি যারা ডায়াবেটিকস রোগে আক্রান্ত হয়নি তাদের জন্য একটা বড় শিক্ষা।

 ডায়াবেটিকস আমাদের স্পষ্ট বার্তা দেয় নিজেদের ইচ্ছা,অনুভূতিগুলোকে বাস্তবে রুপান্তর করার আগে এগুলোকে  আরও সতর্ক ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে বলে।  ডায়াবেটিকস আরও বলে তোমরা তোমাদের ভেতরের  ইচ্ছাগুলোকে পূর্ণ করে নিজেই নিজের ক্ষতি করছো না তো?   


আমি জানি ডায়াবেটিকস সম্পর্কে আগাম ধারনা করা কঠিন কাজএর ধরন, আচরন প্রতিনিয়ত বদলায়। এসব কিছু সত্ত্বেও ডায়াবেটিকসকে জীবন নিয়ন্ত্রন করতে  দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং বর্তমান নিয়ে বাঁচতে শিখুন , আজকের জন্য বাঁচতে শিখুন।  যদি এমন হয় , যদি তেমন হয় , এই “যদি” নিয়ে ভাবনা পুরাই ছেড়ে দিন সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে  আজকের দিনটিকে সবচেয়ে সুন্দর কিভাবে করা যায় তা নিয়ে ভাবুন এবং ভাল কাজের পরিমান বাড়িয়ে দিন। 

 










Comments

Popular Post

নেশার ফাঁদ থেকে মুক্তির আধ্যাত্মিক চিকিৎসা

আত্মার ভেতর এবং বাইরের রহস্য

মাদক, ড্রাগ, নেশা- সর্বনাশা