মনের ভেতর এবং বাইরের রহস্য
মন কি? মন কিভাবে কাজ করে? মনের
কি আলাদা কোন
অস্তিত্ব আছে?
মনঃ
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যকে যে সত্তা বিচার বিশ্লেষণ করে নতুন তথ্য তৈরি করে। ক্ষমতা প্রদান করে, তথ্য বড় করে অথবা ছোট করে, নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে , গতি দেয় অথবা পেছনে টেনে ধরে, গ্রহন অথবা বর্জন করে তাকেই মন বলে । দুধ, চিনি, পানি এই তিনটি জিনিস ব্যবহার করেই হাজারো রকম মিষ্টি তৈরি করে। তেমনি চোখ, কান , নাক, জিহ্বা , চামড়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য দিয়েই মন হাজার , লক্ষ, কোটি কোটি জিনিস বানায়। পৃথিবীতে মানুষের তৈরি যা কিছু আছে তার প্রত্যেকটি প্রথমে মনের ভেতরে তৈরি হয়েছে তারপর বাস্তব দুনিয়াই এসেছে।
মনের গবেষণাগারে যেমন বস্তু তৈরি হয় তেমনি আমাদের দুনিয়াকে সুন্দর, মধুময়, প্রশান্তিময় করার জন্য আবেগ তৈরি হয়। শুধু যুক্তি দিয়ে কিংবা যুক্তির উপর ভর করে পৃথিবী তৈরি হলে দুনিয়া এতো সুন্দর হত না, আবেগই পৃথিবীকে সুন্দর করে , পৃথিবীতে দৃশ্যমান সমস্ত আবেগ মনের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের লক্ষ্যঃ
মানুষের
জীবনের নানান সমস্যার গিট খুলতে এবং জীবনে
নতুন উদ্যম ও গতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করা । মানুষকে
নিজের অন্তর্দৃষ্টির সাথে পরিচয় করে দেয়া এবং যে কোন
সমস্যার সবচেয়ে
সুন্দর সমাধান খুঁজে
বের করতে অনুপ্রানিত করা।
মনের সাধারন বৈশিষ্ট্যঃ
১। মনের কোন
নিদৃষ্ট আকার আকৃতি নেই। মনের নিয়ত
এবং দৃষ্টিভঙ্গি উপরই আকার-আকৃতি তৈরি হয়।
২। মন
খাদ্য হিসেবে রঙ, সৌন্দর্য , বই, প্রকৃতির সান্নিধ্য , চিত্র , কলা, সুর , মানুষের সঙ্গ, ভালবাসা, উষ্ণতা ইত্যাদি তার গ্রহন করে থাকে এবং এগুলোর মাধ্যমে দারুন
ভাবে প্রভাবিত হয়। তবে মনকে খাদ্য না দিয়েও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।
৩। আবেগ বা অনুভূতি তৈরি এবং
প্রকাশের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় । এই পর্যন্ত ৬০০০ আবেগকে শব্দের
মাধ্যমে বন্দি করা গেছে। আরও আনেক অনুভূতি প্রকাশের এবং নাম পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
৪। কোন
প্রকার দেয়াল দিয়ে মনকে আটকে রাখা যায় না। মনের গতি প্রায় অসীম
৫। মনকে
ভেঙ্গে দিয়ে শরীরকেও কষ্ট দেয়া যায়
৬। একটা
মন আর একটা মনের প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুরক্ত হয়।
৭। শরীরের মৃত্যুর মাধ্যমে মনেরও মৃত্যু ঘটে ।
৮। মনের বয়স আর শরীরের বয়সের গতি সমান তালে এগিয়ে যায়
না। কেউ অল্পতেই পেকে ইঁচড়ে পাকা হয়ে যায়।
আবার কোন বৃদ্ধ ৭০-৮০ তে ও
যুবকের মন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।দৃষ্টিভঙ্গির সীমানার উপর মনের বয়স নির্ভর করে ।
যে যত বেশি দূরদৃষ্টি সম্পূর্ণ সে তত
বয়স্ক জ্ঞানী। অর্থাৎ বই পড়ে জ্ঞান অর্জনের
মাধ্যমে মনের বয়স ০ থেকে শুরু করে ১ কোটি বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়া যায়। এবং মানুষের
কল্যাণে কাজ করে এই পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করা যায়। যেভাবে যুগ যুগান্তর ধরে
মহামনিষীরা আমাদের মনে সেভাবেই বেঁচে আছে।
৯। আমাদের শব্দভাণ্ডারের সীমারেখা পর্যন্ত মন চলাচল করতে পারে , আমাদের
শব্দভাণ্ডার বা জ্ঞানের বাইরের জগতের সাথে
যোগাযোগ করতে হলে আত্মার শরণাপন্ন হতে হয়।
মনের পোস্টমর্টেমঃ
মনের দৃশ্যমান অংশ ঃ
এই গুলোই আবেগের দৃশ্যমান রুপ।
মনবিজ্ঞান বলে এই আবেগ গুলোর সংমিশ্রণেই তৈরি হয় অন্যান্য সব আবেগ । যেমন সুখ
আবেগের ভেতরে পায় = ভালবাসা, আনন্দ,
বিশ্বাস ইত্যাদি সব যৌগিক আবেগ , দুঃখের ভেতরে পায় = বিরক্তি, গ্লানি, প্রতারনা
ইত্যাদি , ভয় এর ভেতরে পায় = নির্লজ্জতা , নিরাপত্তাহীনতা , কষ্ট ইত্যাদি । আবার
ছোট ছোট যৌগিক আবেগ মিলে তৈরি হয় অন্য সব শক্তিশালী আবেগ যেমন পরশ্রীকাতরতা = নিজের অযোগ্যতা +
হিংসা + আকাঙ্ক্ষা + ভয়
অভিনন্দন = ভালবাসা + উদারতা +
আনন্দ +বিশ্বাস ।
মনের অদৃশ্য অংশঃ
আবেগের পেছনে যে
জিনিসটি কাজ করে সেটা হচ্ছে হরমোন। এই হরমোনই সব রকম আবেগ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন
করে থাকে। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া, রাগ , বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, ভয়, ভালবাসা , সুখ ইত্যাদি সব আবেগিয় কার্যকলাপে
সরাসরি অংশগ্রহণ করে হরমোন।
ছবি ২ঃ মানব শরীরে হরমোনের
বিভিন্ন উৎস
শরীরে কিছু হরমোন নিঃসৃত হলে যেমন
মনের মধ্যে আবেগ তৈরি হয় তেমনি আবার
বাইরের পরিবেশে কোন আনন্দময়, দুঃখময়, ভয় ইত্যাদি আবেগময় দৃশ্য দেখলে বা শুনলে শরীরে
নানাবিধ এইসব হরমোন নিঃসৃত হয়। আমরা যখন সুখী হই তখন ডোপামেইন হরমোন, যখন রাগান্বিত
হই তখন টেস্টেটরেন হরমোন বেশি পরিমানে উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ শরীর অথবা বাইরের
পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা আমাদের শরীরের
হরমোনের পরিমান বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে বাইরের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রনের
চেয়ে নিজের শরীরের হরমোন বা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ আর জ্ঞানীর কাজ।
গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম তাই সারা পৃথিবীকে বদলে ফেলতে
গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম তাই সারা পৃথিবীকে বদলে ফেলতে
মনের আধ্যাত্মিক রুপঃ
আমরা জানি মনের মধ্যে ভাল আবেগ
এবং মন্দ আবেগ দুইরকম আবেগ বা ইচ্ছারই উদ্ভব হয়।
মনের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অসচেতন
মানুষ মনের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে। যখন ভাল
ইচ্ছার উদ্ভব হয় তখন ভাল কাজ করে , আর যখন মন্দ ইচ্ছার উদ্ভব হয় তখন মন্দ কাজ করে।
অর্থাৎ মন যখন যা বলে তাই সে শোনে, ভাল – মন্দের খুব একটা বিচার করে না। তবে মানুষ
যখন আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী হয় তখন সে চিন্তা করে তার প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা
করা লাগবে একদিন । সে জানতে পারে তার ভাল এবং মন্দ ইচ্ছাগুলোর ইন্ধন ফেরেস্তা এবং শয়তান দেয়। তাই সে নিজের মন , আবেগ ,
হরমোনের ব্যাপারে সচেতন হয়। তখন ভাল এবং
মন্দের পার্থক্য তার কাছে আরও স্পষ্ট হয়। এ
ব্যাপারে আমরা আত্মা অংশে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
মনের পোস্টমর্টেমের এবং সার্বিক
বিচার বিশ্লেষণের পর আমরা কিছু
সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি সেগুলো হল ঃ
১। আমাদের শব্দভাণ্ডারকে ঘিরে আমাদের মনের বিচরন
ক্ষেত্র। একজন খেটে খাওয়া দিন মুজুরের শব্দ ভাণ্ডার ২-৬ হাজারের মধ্যে থাকে , একজন
মাস্টার্স পাশ করা ছাত্রের থাকে ১২-২০ হাজার , একজন গবেষক, কূটনীতিক এর থাকে ৩০-৪০
হাজার শব্দ । সুতরাং বুঝতেই পারছেন সাধারন মানুষ কেন সাধারন থাকে আর একজন গবেষক , কূটনীতিক কেন অসাধারন হয়ে উঠে?
২। মনের
সীমারেখা সীমিত যেমনঃ “উজুবা” বললে আপনি
মনে মনে কোন ছবি কল্পনা করতে পারেন না । কারন
মন আগে কখনও এই শব্দ শুনে নাই এই শব্দের সাথে পরিচিতি নাই, তাই মনের কোন গতিবিধিও
নাই এই শব্দ ঘিরে। অর্থাৎ মন কেবলমাত্র
তাই উপলব্ধি করতে পারি যার তথ্য মনের সাথে আগে থেকেই পরিচিতি করে থাকি।
৩। মন আংশিক
অন্ধ থাকে সবসময়।
একদিকে মনোযোগ দিলে অন্য দিক গুলো বন্ধ হয়ে যায় । অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে ? এই মুহূর্তে আপনার চারপাশের পরিবেশ থেকে শুধু
যেগুলো সবুজ রঙের সেগুলো গুনতে শুরু করুন। কয়টা সবুজ রঙের বস্তু পেয়েছেন – ১৫ টা
খুবভাল কথা । এই বার লাল রঙের বস্তু গুনতে শুরু করুন। পেয়েছেন – ১২ খুব ভাল। এইবার
সাদা রঙের বস্তু গুনতে শুরু করুন। পেয়েছেন ১৮ টা । বেশ গননা শেষ করেছেন। এইবার
আমার প্রশ্নের উত্তর দিন – আপনি যখন লাল রঙের বস্তু গননা করছিলেন তখন কি সাদা রঙের
বস্তু দেখতে পেয়েছিলেন। কিংবা যখন
সবুজ রঙের বস্তু খুজছিলেন তখন কি লাল রঙ
দেখতে পেয়েছিলেন? অর্থাৎ আপনি তাই দেখতে পান যা আপনি দেখতে চান। এই কাজটি করে
মস্তিস্কের Reticular Activating System RAS ( )
পরে এই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেব।
৪। আমাদের মন হুকুমের গোলামি করে। তাকে
কাজ দিবেন সে কাজ খুব ভাল ভাবে করবে।
কিন্তু যদি তাকে ছাড় দেন যদি উপযুক্ত কাজে ব্যস্ত না রাখেন তাহলে সে আপনাকে ব্যবহার করবে তার ইচ্ছামত। আর মনের একটি ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে একে কোন কিছু
দিয়েই সন্তুষ্ট করা যায় না , তৃপ্ত করা যায় না!
৫। আপনার মন যেদিকে যায় সেদিকে শক্তি
প্রবাহিত হয় , নতুন সৃষ্টি হয় সেইদিকে , সেই দিকের দক্ষতা বাড়ে। “ যাহা দৃষ্টি তথা সৃষ্টি”
৬ । মানুষের
মনে ভীতি উৎপন্ন হলে দেহ হতে রাসায়নিক দ্রব্য ও হরমন নির্গত হয়।
৭। শতকরা
৯০ ভাগের বেশি রোগ হয় মানসিক চাপ অর্থাৎ হরমোনের ইমব্যালান্স বা আবেগের ভারসাম্যহীনতার কারণে।
৮। মন নানা রকম তথ্য উপাত্ত নিয়ে
কাজ করে তাই মনের মধ্যে বিশাল জঞ্জাল বা মনোরোগ
তৈরি হয়। চিন্তা করে দেখুন একটা অফিসে ২০-৩০ বছর ধরে কোন জঞ্জাল না
পরিস্কার হলে কি অবস্থা তৈরি হবে। বেশিরভাগ মনের রোগ গুলোও এই রকমেরই মন নিজেই
নিজেকে পরিস্কার করতে পারে না, এই জন্য আত্মার বা আধ্যাত্মিকতার চর্চার দরকার হয়।
৯। মন, মনের সমস্যা , মনের রোগ
সম্পর্কে সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।
শুধুমাত্র আমেরিকাতে মনের সমস্যার কারনে ৩৮০০০ জন মানুষ মারা যায়। আরও কত শত মানুষ
ড্রাগের নেশায় বুদ হয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে তার ইয়াত্তা নেই। অর্থাৎ
মন শরীরকে ধংস করে দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি কথা বলেছিলেন
মনে পড়ে গেল –
You can’t solve a
problem on the same level it was created . You have to rise above it to the
next level .
অর্থাৎ যে স্তরে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেই স্তরে সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে
পাওয়া যাবে না । সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য উঁচু স্তরে যেতে হবে। তাই
মনের কার্যকর চিকিৎসার জন্য আধ্যাত্মিকতা চর্চার অনুশীলন করতে হবে।
অর্থাৎ যে স্তরে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেই স্তরে সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে
পাওয়া যাবে না । সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য উঁচু স্তরে যেতে হবে। তাই
মনের কার্যকর চিকিৎসার জন্য আধ্যাত্মিকতা চর্চার অনুশীলন করতে হবে।
Comments
Post a Comment